মোচ্ছব কাকে বলে? যখন কলকাতা ডুবুডুবু, গ্রামে খরা। যখন মুখ্যমন্ত্রী গান গাইছেন, এক পুরোনো মেয়র ফোটোশুট করছেন, আরেকজন মামলা। যখন কাশফুল বাড়ন্ত, দিগ্বিদিকে দেদার ডিজে-বক্সের কলধ্বনি। যখন বিচারক টিভিতে টিআরপি বাড়াচ্ছেন, যখন আন্দোলনরতরা রাস্তায়, আর পাবলিক সেজেগুজে পথে নেমেছে।যখন শারদসম্মানে ঢুকে যাচ্ছে "সেরা সেলফি জোন"এর পুরষ্কার, মেয়েরা আক্ষেপ করছে, কেন এবারই "সেরা রিল এলাকা"টা হলনা। চিন্তার কিছু নেই, আসছে বছর নিশ্চয়ই হবে। তখন রিলে রিলে কিলবিল করবে নেট-দুনিয়া। টিকটককে পিছনে ফেলে মেটা আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। একে কেউ কেউ ফালতু ক্যাকোফনি বলেন, আমরা বলি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। এইসবই আমাদের উৎসবের যুগলক্ষণ। উৎসব তো আকাশ থেকে পড়বেনা, জীবন যেরকম, তেমনই হবে। এরই মধ্যে কলকাতার পুজো আবার হেরিটেজ তকমা পেয়ে গেছে। রাস্তার শিল্পে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্ভার, নিঃসন্দেহে কলকাতারই। আমাদের দীনতা আর হীনতার মধ্যেও, আমাদের পারা আর না পারার মধ্যে, আমাদের যুদ্ধ আমাদের স্বার্থপরতার মধ্যে, থাকনা আমাদের ভালোটুকুও, থাক না, আমাদের হুল্লোড়, আমাদের ক্যাকোফনি। ... ...
‘রাইনার, এই যে সব মানুষ তোমাদের ব্যাঙ্কের হলঘরে বসেছিলেন, এঁরা কারা? এদের কাউকে ব্যাঙ্কার কেন, এমনকি শিল্পপতি বলেও তো মনে হল না?’ রাইনার বললে, চুপ কর দেখি (জাই রুহিগ)। তুমি কি মনে কর তোমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ ঋণের পারিশ্রমিক নিয়ে আমাদের ব্যাঙ্ক চলে? ঘরভাড়া ওঠে না। এখানকার খরচা জান? যাদের দেখলে, তারা আমাদের প্রাইভেট ব্যাঙ্কের গণ্যমান্য মক্কেল। সোজা বাংলায় (এর সরাসরি জার্মান আছে – আউফ ডয়েচ গেজাগট) করপ্রদানের পরিমাণ কমানোর জন্য আমাদের সঙ্গে এখানে কারবার করে। অ্যাকাউন্ট খোলে। টাকা তোলে। জমা দেয়। তারাই আমাদের রুটি রুজির মালিক’। আমার প্রশ্ন তখনো ফুরোয়নি। আমি বললাম, রাইনার, এদের পোশাক-আশাক, এমনকি সম্পূর্ণ বেমানান স্পোর্টস জুতো দেখলে তো হাঘরে মনে হয়। এরা তোমাদের মূল্যবান মক্কেল? কী গুল দিচ্ছ?’ ... ...
কিন্তু আজ থেকে সহস্রাধিক বছর আগেও কি পৌরুষ আর নারীত্ব আজকের মতো একইরকম বিপ্রতীপ মাপকাঠিতে নির্ধারিত হতো, নাকি এই দুই সমান্তরাল রেখা মিলেমিশে সেসময় গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মানবের অন্যতর কোন পরিচয়? গত দশকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছিলেন নিউ ইয়র্কের ম্যানহ্যাটানভিল কলেজের অধ্যাপিকা তথা শিল্প ঐতিহাসিক মেগান সিফারেলি। প্রাপ্ত যে কোন প্রাচীন দেহাবশেষকে নারী ও পুরুষ নামক দুটি লিঙ্গে দেগে দেওয়ার বাঁধা গতকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন এক উত্তরের আশায় গবেষণার জন্য ইরানের মরু-মালভূমির গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নকেন্দ্র তথা লৌহ-ব্রোঞ্জযুগের বাণিজ্যনগরী টেপ হাসানলুর প্রাচীন সমাধিগুলিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি এবং খুঁজে বেরও করেছিলেন মানব যৌনতার তৃতীয় স্বরের বেশ কিছু অসামান্য নিদর্শন। ... ...
প্রায় এক হাজার বছর আগের বাংলা। ১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ, পাল রাজবংশের অন্ধকার যুগ চলছে। সিংহাসন নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই শুরু হয়েছে। সাম্রাজ্যের পরিধি ক্রমশই ক্ষুদ্র হচ্ছে। বাঙালীর গর্ব অতীশ দীপঙ্কর বিক্রমশিলা মহাবিহার ছেড়ে তিব্বতে চলে গেছেন প্রায় ত্রিশ বছর হলো। চারদিকে শুধুই অন্ধকার। তার মধ্যে একটি প্রদীপের দীপ্ত শিখার মতো জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন চিকিৎসক চক্রপাণি দত্ত। প্রথম বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক, যার রচিত পুস্তক এক হাজার বছর পরেও আজও সমস্ত ভারতবর্ষের আয়ূর্বেদিক কলেজগুলিতে পড়ানো হয়। সে দীপ শিখাও কি নিভে যাবে? ... ...
কিন্তু কাল রাতে একটা জব্বর নাম এসেছে মাথায়। সেটা নিনিকে বলতে হবে। আর দশটা কাজে জড়িয়ে পড়ার আগে। তাই অপেক্ষা করে পৃথা। মেপে মেপে ক্যারাফেতে জল ঢালে। বসিয়ে দেয় বার্নারে। তারপর গ্যাসের নব ঘোরায়। খোলা জানলা দিয়ে চুইয়ে আসে ভোরের তরল, পাতলা অন্ধকার। এক দৈবী আলোর মত গ্যাসের শিখারা লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। হাইড্রোকার্বনের অণুগুলো ক্যারাফের তলা ছোঁয়। পৃথার মনে পড়ে যায়, ওর মায়ের কথা। প্রথম যেদিন ওকে কাঁচের ক্যারাফে গ্যাসের আগুনে বসাতে দেখেছিল, কি ভয়টাই না পেয়েছিল! যদি আগুনের শিখায় কাঁচ ফেটে যায়! ওই ভয়টা! ভয়টাও ওদের পোর্টফোলিওতে চাই। মনে মনে নোট করে পৃথা। হয়ত এক্ষুণি কাজে লাগবে না। কিন্তু ইটস ইউনিক। কিছুটা না-জানা, ফ্লেম প্রুফ ব্যাপারটাই মা বোঝে না, কিছুটা মেয়েকে সব বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া, সব কিছুর একটা পারফেক্ট পাঞ্চ। ... ...
পারমিতার অবিশ্বাস্য লাবিয়ার তুলতুলে কুচুরমুচুর গোলাপি অনায়াস ঠোঁটের মাঝে চারভাঁজ করা দুটো দু’হাজার টাকার করকরে পিঙ্কি-পিঙ্কি নোট কালো বেঁটে কদমছাঁট চাপদাড়ি সোনার বোতাম হাফকুর্তা হেটোধুতি কুলীন খদ্দের চার্বাক টিরিনচাগা (বংপুং) গুঁজে দেবার পর ব্যাপারটা স্পষ্ট হল গলা খ্যাঁকারির পর দরোজায় তিনটে টোকা পড়তে ফুলকলি ওরফে নিভা ওরফে রানি ওরফে মৌসুমী ওরফে পারমিতা সন্ধ্যা হলে যার নাম রোজই পালটে যায় ... ...
"আদ্যাশক্তি মহামায়া" বা "দুর্গা দুর্গতিনাশিনী" এইসব নামে ছবি হত এককালে। আরো অনেক ছবিতেই মা দুর্গা থাকতেন। মাটির মূর্তির পেছন থেকে জলজ্যান্ত মা দরকারে অদরকারে আসতেন। কিছুটা আবছা মনে আছে। কারণ সেইসময় আলেয়া সিনেমা নামে একটি হল ছিল আর দিদু ম্যাটিনি শো' তে নাতনীকে নিয়ে আদ্যাশক্তির শক্তি দেখতে যেতেন। আমার কিন্তু মনে আছে "অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি"। তনুজা গরদ পরে বেশ বাংলার বধূ হয়ে পিদিম জ্বালাচ্ছেন, গ্রামের লোক ঘরে আগুন লাগাচ্ছে, অ্যান্টনি বাইরে বাইরে কবিগান করে বেড়াচ্ছেন। দুর্গাপূজা এইছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। একটা ইস্যু ছিল। যে ফিরিঙ্গির বাড়িতে তার একদা বাঈজী এখন বধূ দুর্গাপূজার আয়োজন করতে পারে। এটা, এখন মনে হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ঘটনা। দুর্গাপূজার একটা বিশাল সামাজিক দিক আছে। একটা প্রিজম যেন। অনেক অনেক আলোর বিচ্ছুরণ। তার কিছুটা অ্যান্টনি সাহেবের দুর্গাপূজার আয়োজনে ধরা পড়ে। তাও প্রায় একক আয়োজন। সেটা কতদূর সম্ভব জানি না। মানে কে তাঁকে প্রতিমা গড়ে দিল? কেই বা জোগাড় দিল এই বিশাল পূজার? তবু নাহয় গল্পের খাতিরে মানা গেল যে স্বামী স্ত্রী মিলে একটা যেন আনন্দোৎসব করছেন, ঘটনা তো আসলে উত্তমকুমার। ... ...
ঋষি গৌতম খুব অন্যমনষ্ক থাকেন ৷ কোন কাজে মনসংযোগ করতে পারেন না৷ কেন এমন হয়েছে তা তিনি বুঝতেই পারছিলেন না৷ আশ্রমের চারিদিকে বসন্তের রঙ লেগে যায় ৷ গাছে গাছে পাখিরা কলরব করে৷ হাওয়ার রঙ বদলায়৷ ঋষি গৌতম তাঁর আশ্রমের মাথার চাল মেরামত করছিলেন। তাঁর দিন কাটে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। তাঁর পক্ষে পিছনের ছায়া দেখা সম্ভবপর নয়৷ এমন সময় ঋষি নারদের আগমন ঘটে। ঋষি গৌতম একটুও আশ্চর্য্য হলেন না নারদকে দেখে। তাঁরা একসাথে কাজ করেছেন ধর্মসূত্র নিয়ে এবং গৌতম জানেন ঋষির আগমনের সম্ভাব্যতা৷ নারদের চরিত্র ভীষণই অকল্পনীয়! সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে উপস্থিত হন তিনি৷ ... ...
যতই হোক, কাকভোরে ওঠাটা তিরিশ বছরের অভ্যাস বলে কথা। সে অভ্যাস তার জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। এসব নানা ভাবনার মাঝেই কুরুরু কুরুরু করে রাতের শেষ পালার বা দিন শুরুর ঢ্যাড়া-ঘোষণ দিতে প্যাঁচা ডেকে ওঠে। রাইসমিলের পুব দিকের গেটের পাশের আমড়াগাছে একজোড়া কোটরেপ্যাঁচা থাকে। সুকুমণি শব্দ শুনে নির্ভুল দিক গণে দিতে পারে। সেই ডাকে শেষ রাতটা কেমন ঝমঝম করে ওঠে। উসখুশ ভাব জাগে আকাশে বাতাসে। মিল থেকে লরীর শব্দ আসে। ইঞ্জিন গর্জে উঠে খানিক মকসো করে বেরিয়ে যায় লোড করা চাল নিয়ে কোন হিল্লিদিল্লি। ড্রাইভার খালাসীদের গলা খাঁকারি শোনা যাবে তখন। কারও বা আচমকা জোরে ডেকে ওঠায় কেমন যেন পরিবেশটা সজাগ হয়ে উঠে চোখ কচলে বড় করে তাকাবে। আরও বেশ খানিক পরে মশাগ্রাম থেকে বাঁকুড়াগামী দিনের প্রথম ট্রেনটিও এসে পড়বে হুড়মুড়িয়ে। ... ...
জ্ঞান হওয়া ইস্তক শ্যামাপিসিমা কে দেখে এসেছি। একমাত্র দাদু তাকে ডাকতেন "কই গ্যালা, শ্যামা? " বলে। আর কারো বোধহয় শুধু নাম ধরে ডাকার অধিকার ছিল না ... হিম্মতও নয়। ঠাকুমা, ছোট ঠাকুমা কোন অদ্ভুত কারণে তাকে বেশ সমীহ করেই ডাকতেনঃ 'স্যাকরা বৌ ' বলে। বাবা-কাকা-পিসিরা ডাকতো 'শ্যামা দি ' আর আমরা বলতাম - 'শ্যামা পিসিমা '। উনি ঠাকুমাদের ডাকতেন বড়-মা , ছোট-মা নামে, বাবা-পিসিদের সরাসরি নাম ধরে আর আমাদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই আনতেন না। একেবারে নিজের ইচ্ছেমতো নাম দিতেন ... এবং ২০০% বাঙ্গাল অ্যাকসেণ্টে। যে কোন কারণেই হোক সেই নাম গুলিও হতো প্রাক স্বাধীনতা আমলের নেতৃবৃন্দের স্মরণে। ... ...
কত সুন্দর হতে পারতো ওদের জীবন। কী দারুণ ভাস্কর্য বানাতো হিল্লোল। শুধু হাতের কাজ নয়, থিওরিটিক্যালেও খুব ভালো নম্বর পেতো হিল্লোল। রেজাল্ট এত ভালো ছিল যে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওকে লুফে নিতো। আর তা না হলে নিজেই একটি আর্ট ফার্ম দিয়ে এতদিনে দেশের প্রায় সব বড় বড় প্রজেক্টের সাথে যুক্ত থাকতে পারতো। কিন্তু সে সবে জল ঢেলে হিল্লোল এখন গোবিন্দগন্জ পৌরসভার মেয়র। ... ...
কলকাতার বিকাশ এবং বাংলার বিকাশ এক ধারায় হয়নি। আজকের দুনিয়ার মতো সেদিনের দুনিয়া “গ্লোবালাইজড” হয়ে যায়নি। এজন্য উপনিবেশের অর্থনৈতিক, সামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কলকাতা যেভাবে পরতে পরতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেভাবে সমগ্র বাংলার রূপান্তর ঘটেনি। উনবিংশ শতাব্দীর ৩য় দশকের আগে কলকাতার সাথে বৃহত্তর গ্রামীণ বাংলার উভয়মুখী যাত্রাও দুর্বল ছিল। ফলত কলকাতার খণ্ডচিত্র ভিন্নধর্মী – বাংলার অন্য অংশের চেয়ে। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১০ কার্তিক ১২৪১ তথা ২৫ অক্টোবর ১৮৩৪-এ প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়েছিল – “বঙ্গ দেশে যে ৩ কোটি লোক আছে তাহারদিগকে ইঙ্গলণ্ডীয়রা ৯০০ সামান্য গোরা সিপাহী ও ১০০ ফিরিঙ্গি ও ২১০০ সামান্য সিপাহী অর্থাৎ বরকন্দাজ লইয়া জয় করিলেন এবং মুষ্টি পরিমিত সৈন্যের অধ্যক্ষ ৩১ বৎসর বয়সের মধ্যে এক জন অর্বাচীন অর্থাৎ লার্ড ক্লাইব ছিলেন ... দেখুন বঙ্গদেশীয় জমিদারদের মধ্যে ঘোড়ায় চড়িতে পারেন এমত ৫০ জন পাওয়া ভার অতএব বঙ্গদেশীয় লোকেরদের দ্বারা কি প্রকারে ভয় সম্ভাবনা।” (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদিত, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ১৯৩) এ লেখার মাঝে চরম আত্মগ্লানি আছে। কিন্তু কলকাতার জনসমাজকে এ কথাগুলো সেভাবে স্পর্শ করেছিল কি? ... ...
প্রথমদিন তোমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে লেগেছিল হার্ডলি সাঁইত্রিশ সেকেন্ড, কিন্তু মাথার অ্যালবামে পজ বাটনের প্রিভিলেজ আছে। কারও রসিকতায় হেসে ওঠার মুহূর্তটায় তোমাকে স্থির করে দিই। ঠোঁট নয়, গলা নয়, শরীরের ভরকেন্দ্র থেকে ঘূর্ণি তুলে বেরিয়ে এসেছে তোমার হাসি যেমন আসে, কক্ষপথ থেকে ছিটকে দেয়, পতন সামলাতে তোমাকে আশেপাশের কাউকে বা কিছুকে আঁকড়ে ধরতে হয়। এগিয়ে যাই। এত কাছে যাতে আমার নিঃশ্বাসে তোমার ঘাড়ে লেপ্টে থাকা চুল উড়তে পারে। প্রদক্ষিণ করি। মনোযোগ দিই গ্রীবার বাঁকে। বোজা চোখের পলকে। দাঁতের সুসংবদ্ধ শুভ্রতায়। জিভের গোলাপি আভায়। কাঁপুনি ধরে প্রতিটি রোমকূপে। শরীরের ভেতর আরেকটা শরীর জাগে। জানালার ওপারে আমগাছের মাথায় গনগনে চাঁদ। পূর্ণিমা আসন্ন, বা সদ্য গত। সে গলন্ত সোনার আঁচে শুয়ে তোমার কথা ভাবতে ভাবতে ছাই হয়ে যাই। ... ...
সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক আগে মানুষ একটা ছবি হাতে নেয়; ফ্রেম থেকে খুলে, হাতের মুঠোয় পাকিয়ে ফেললে গোটানো ক্যানভাসকে রিলে দৌড়ের ব্যাটনের মত লাগে । তারপর কোথাও হুইশল বাজে, ব্যাটন হাতে সে এবার এক পা দু পা করে পিছু হটতে শুরু করে; একটু থামে , হাতের ছবি খুলে কিছু দেখে, পিছোয় আবার; তারপর হাঁটার গতি বাড়ে, একটা সময় স্প্রিন্ট টানে সে , উল্কার বেগে সম্পর্ক থেকে বহু দূরে চলে যায়। প্রতিটি শেষ হওয়া সম্পর্কের সঙ্গে একটা করে ছবি থাকে - আমার এরকম মনে হয়; ফ্রেমহীন ছবি সব - হয়তো পুরোনো সম্পর্কের ওয়াটার কালার - লাল রঙে চুবিয়ে তোলা, কিম্বা পরের সম্পর্কের ঝকঝকে প্রিন্ট- গ্লসি ফিনিশ; অথবা হয়তো গোটাটাই অ্যাবস্ট্রাক্ট - একটা অবয়ব হয়তো, আপাতদৃষ্টিতে যাকে মনে হয় নৃত্যরত মানুষ, ডানা ঝাপটানো রাজহাঁস, ছুটন্ত ঘোড়া - কেশর উড়ছে; অথবা জাস্ট অন্ধকার, পিচ ডার্ক শূন্যতা। ... ...
সর্বশেষ প্রশ্নপত্রটা বিলি করার পর পরীক্ষক যখন হলটির ডায়াসে এসে পৌঁছুলেন, চোখ পড়া মাত্রই দৌড়ে গেলেন দীপের দিকে, আর হাত থেকে বইটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে একটা প্রশ্নপত্র গুঁজে দিলেন। খাতা আগে থেকেই রাখা ছিল, সামনের পকেটটা অনেকক্ষণ ধরে কামড়ে থাকা জ্যামিতি বক্সটা কোনমতে বের করে দীপ তার জন্য নির্ধারিত আসনে সটান বসে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতেই এক ঝলক দেখে নিয়েছিল, এখন পুরো প্রশ্নপত্রটা দেখে তো সে আনন্দে আটখানা হয়ে উঠলো। শতভাগ কমন! এমনকি ‘অথবা’ দেয়া বিকল্প প্রশ্নগুলোও তার ঝাড়া মুখস্ত। কোনটা রাখবে, আর কোনটা ছাড়বে, এ নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ভাবলো সে। পরে জ্যামিতি বক্সটা খুলে যুৎসই একটি কলম বেছে নিয়ে লিখতে শুরু করলো। ... ...
ভোররাত থেকেই জলহাওয়া মেঘ থমথমে। সকাল থেকেই চারিদিক আঁধার।ভোর শেষ হয়নি তখনো।চারিদিক জনহীন, বাজারের দিকে শুধু ভিড়। সাইকেলে চেপে ঘুরে ঘুরে দেখছি দশদিক।ফলের ঝাঁকা নিয়ে পাতাইহাটের লোক, নতুন গামছা নিয়ে জগদানন্দপুর, মাটির জিনিস ও পদ্মফুল নিয়ে ঘোড়ানাশের মানুষজন বসে আছে। ঢাক নিয়ে আসে ঢাকিদের ভিড়ের পাশাপাশি সাহেবতলার কাছে দেখলাম একদল হিজড়ে।ঢাকে এখন বক মেরে পালক গাঁথা বন্ধ হয়েছে। হিজড়েদের হাতে ঢোলক একটা, রঙিন জামাকাপড়, দূরের দিকে তাকিয়ে আছে চুপ করে। বোলান নাচের দল, গাজনের সঙ, রিক্সা চড়ে হাততালি দিয়ে পাড়া কাঁপানো হিজড়ে দেখে বড়ো হয়েছি।ঢোল কাঁধে কোমর বাঁকিয়ে নেচে-কুঁদে বলেছে - 'এই বাবু, টাকা না দিলে তোর উঠোনে দাঁড়িয়ে শাড়ি তুলে ঢোলে জল ঢেলে দিব'।সেই নাচের কী তীব্রতা,সমস্ত না-পাওয়া নাচে ফুটিয়ে তুলে কী প্রচণ্ড বেঁচে থাকা, চড়া গলার খটখটে গান আকাশের ঠোঁট অবধি ছুঁয়ে ফেলছে। ... ...
অনিমা দাশগুপ্তের নাম আমি আগে শুনিনি। আমার অজ্ঞতা। গান শোনা তো দূরের কথা। সম্প্রতি রেডিয়োর অনুষ্ঠানসূচির পুরনো ইংরেজি বুলেটিন, 'দ্য ইন্ডিয়ান লিসনার' হঠাতই ইন্টারনেটে ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই নামটি আবিষ্কার করলাম এবং অনুসন্ধিৎসু হয়ে ইউটিউবে শুনে ফেললাম "উলফাৎ নে জিসে বানায়া থা"। ১৯৪৯ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত "ইরান কি এক রাত" ছবিতে কমল দাশগুপ্তের সুরে এই গানটি গেয়েছিলেন অনিমা দাশগুপ্ত। গীতিকার কে ছিলেন জানতে পারিনি। অভিনয় করেছিলেন যমুনা বড়ুয়া এবং চন্দ্রাবতী। এমন এক শিল্পীকে আবিষ্কার করায় আমার অচেনাকে চেনার, অজানাকে জানার আনন্দ হল। যে গান আগে শুনিনি, সেই গান শোনার সুযোগ পেয়ে আরও ভালো লাগল। আর সেই ভালোলাগা থেকে খুঁজে নিলাম তাঁর গাওয়া আরও গান। গানে-গানে, সুরে-সুরে দিনটি ভরে উঠল অদ্ভুত মাধুর্যে। ... ...
মেগামার্টের চত্বরে বাইকটা পার্ক করতে করতেই বৃষ্টি এসে গেল। এখানে বৃষ্টি, হয় আকাশ থেকে বালতি উপুড় করে জল ঢালে নয়ত জলের গুঁড়ো স্প্রে করে। দুটোর কোনওটাতেই ছাতা কোনও কাজে লাগে না।আজকে অবশ্য বৃষ্টি মাঝারি গতিতে একদম সোজা নেমে আসতে লাগল, ছাতা থাকলে কাজেই লাগত। জিতু অল্প দৌড়ে মিঠাসের ভেল কাউন্টারের শেডের নীচে উঠে দাঁড়াল। হেলমেট খুলে মাথায় পেঁচানো বড় কাপড়টা খুলে হাত ঘাড় মুছে পিঠের ব্যাগটায় হাত দিয়েই চমকে ওঠে। হাতে চ্যাটচ্যাটে মত কি যেন লেগে যাচ্ছে। কাপড়ে ঘষে মুছে তাকিয়ে দেখে টমেটো কেচাপের মত রঙ আর গন্ধটা … গা গুলিয়ে ওঠা। ... ...